কেভিন ডি ব্রুইনা: ফুটবলে এক যুগের অন্তিম অধ্যায়

কিছু কিছু বিদায় থাকে যা মেনে নেওয়া কঠিন, যা হৃদয়ের গভীরে একটা শূন্যতা তৈরি করে। কেভিন ডি ব্রুইনা, ম্যানচেস্টার সিটির প্রাণভোমরা, ঘোষণা দিয়েছেন এই মৌসুম শেষেই তিনি ক্লাব ছাড়ছেন। এ খবর যেন শুধুমাত্র সিটি ভক্তদের নয়, সমস্ত ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ে এক শোকের ছায়া ফেলেছে। তার বিদায় মানে শুধু একজন খেলোয়াড়ের চলে যাওয়া নয়, বরং এক যুগের সমাপ্তি।

আমি একজন লিভারপুল ভক্ত। গত কয়েক বছর ধরে ম্যানচেস্টার সিটিকে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখে আসছি। যখনই আমাদের ম্যাচ থাকত, আমি চাইতাম কেভিন যেন না খেলেন। কারণ, তিনি মাঠে থাকলেই আমার মনে ভয় কাজ করত—এই বুঝি একটা মাস্টারক্লাস পাস দিয়ে দিলেন, এই বুঝি দূরপাল্লার এক শটে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন! তার উপস্থিতি মানেই বিপদের বার্তা। আমরা তাকে ঘৃণা করতে চাইতাম, কিন্তু পারতাম না—কারণ একজন প্রতিপক্ষ যখন এতটা নিখুঁত, এতটা ভয়ংকর হয়, তখন তার প্রতি মুগ্ধতা কাজ করতেই বাধ্য।

কিন্তু কেভিন ডি ব্রুইনার যাত্রা শুধুমাত্র সিটিতে এসে শুরু হয়নি। তিনি ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অন্তর্মুখী, তার চারপাশের মানুষ বুঝতে পারেনি যে এই শান্ত-শিষ্ট ছেলেটিই একদিন বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার হয়ে উঠবে। এমনকি এক সময়কার পালক পরিবার তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল এই বলে যে সে খুব চুপচাপ, তার মধ্যে নাকি প্রাণবন্ত কিছুই নেই। সেই প্রত্যাখ্যান এক দগদগে ক্ষত হয়ে গেঁথে ছিল কেভিনের মনে, কিন্তু সে হার মানেনি। এই কষ্টকে শক্তিতে পরিণত করে সে নিজেকে প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে গেছে। তার প্রতিভা দেখে জেনক তাকে দলে নেয়, আর সেখান থেকে শুরু হয় এক স্বপ্নযাত্রা।

"সত্যিকারের প্রতিভা কখনও হারিয়ে যায় না, বরং প্রতিকূলতা তাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।" - কেভিন ডি ব্রুইনা

তবে ফুটবলের মাঠে যতটা সংগ্রাম ছিল, তার ব্যক্তিগত জীবনও কম কঠিন ছিল না। কল্পনা করো, তুমি এমন একজনকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো, যাকে তুমি নিজের ভবিষ্যতের অংশ ভেবেছো, যার সাথে তুমি স্বপ্ন দেখেছো সারাজীবন একসাথে থাকার, কিন্তু সেই মানুষটাই তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে! কেভিন ডি ব্রুইনা যখন জীবনের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছিলেন তার প্রেমিকা ক্যারোলিন লিজের জন্য, তখন হয়তো কল্পনাও করতে পারেননি, একদিন সেই মানুষটিই তাকে ধ্বংস করে দেবে।

তার এক সময়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধু একদিন কেভিনকে জানালেন যে ক্যারোলিন লিজ তার সাথে প্রতারণা করছেন। প্রথমে তিনি বিশ্বাসই করতে পারেননি, কিন্তু যখন সত্য বেরিয়ে এলো, তখন তার হৃদয় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। এমন না যে তিনি কেবল একজন প্রেমিকাকে হারিয়েছিলেন, বরং তিনি বিশ্বাস হারিয়েছিলেন প্রেমের প্রতি, আস্থার প্রতি, বন্ধুত্বের প্রতি। তিনি ভেঙে পড়েছিলেন, রাতে ঘুম আসত না, কষ্টে হৃদয় ফেটে যেত। প্রেমিকার বিশ্বাসঘাতকতা এমনই এক যন্ত্রণা, যা শুধু একজন ভুক্তভোগীই অনুভব করতে পারে। কিন্তু এখানেই কেভিন ডি ব্রুইনা আলাদা। এই কষ্টকে তিনি শক্তিতে পরিণত করলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ফুটবলই হবে তার প্রতিশোধ। তিনি তার দুঃখ, তার হতাশা, তার যন্ত্রণাকে শক্তিতে পরিণত করলেন এবং আরও উন্নতি করতে লাগলেন। পরে তার জীবনে মিশেল লাক্রোয়ার আসেন, যিনি কেবল তার স্ত্রী নন, বরং তার সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে ওঠেন।

জেনকে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর, ইংল্যান্ডের সবচেয়ে প্রতিভাবান তরুণদের মধ্যে তিনি পরিণত হন এবং ২০১২ সালে চেলসি তাকে দলে নেয়। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি বুঝলেন, প্রতিভা থাকলেই সুযোগ মেলে না। হোসে মরিনহোর অধীনে তিনি শুধুই বেঞ্চের একজন খেলোয়াড় হয়ে রইলেন। মাত্র তিনটি প্রিমিয়ার লিগ ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি, যা তার মতো প্রতিভার জন্য অসম্মানের মতো ছিল। মরিনহোর চেলসিতে তার জায়গা হয়নি, তাকে ধারে পাঠানো হলো ওয়েডার ব্রেমেনের কাছে। সেখানেই তিনি নিজের প্রতিভার প্রথম ঝলক দেখালেন, বুন্দেসলিগায় নিজেকে প্রমাণ করলেন। কিন্তু চেলসিতে ফেরার পরও তার জন্য কোনো জায়গা ছিল না। কেভিন বুঝে গিয়েছিলেন, এখানে থেকে নিজের স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব নয়।

তারপর ওলফসবুর্গে যোগ দেন, যেখানে তার ফুটবল সত্যিকারের রূপ পায়। এক মৌসুমে ২১টি অ্যাসিস্ট করে তিনি পুরো ইউরোপের নজর কাড়েন, জার্মানির সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। সেই মুহূর্তে ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলোর চোখ তার দিকে পড়েছিল, কিন্তু সবচেয়ে বড় অফার নিয়ে এগিয়ে আসে ম্যানচেস্টার সিটি। ২০১৫ সালে পেপ গার্দিওলার দল তাকে রেকর্ড পরিমাণ ট্রান্সফার ফিতে দলে ভেড়ায়, আর এখান থেকেই শুরু হয় নতুন এক যুগ।

সিটিতে এসে যেন কেভিন নিজেকে খুঁজে পেলেন। পেপ গার্দিওলার অধীনে তিনি পরিণত হলেন বিশ্বের সেরা মিডফিল্ডারদের একজনে। তার দূরদর্শী পাস, তার বজ্রগতির শট, তার খেলার প্রতি নিবেদন—সব কিছু মিলে তিনি হয়ে উঠলেন ফুটবলের এক চিরস্মরণীয় চরিত্র। তিনি ছিলেন এমন এক খেলোয়াড়, যে বল পেলেই মাঠে জাদু সৃষ্টি করত।

আজ, এত বছরের যাত্রার পর, বিদায়ের ক্ষণ এসে গেছে। আমরা জানি, ফুটবল নিষ্ঠুর, প্রিয় খেলোয়াড়দের একদিন বিদায় জানাতেই হয়। কিন্তু কেভিন ডি ব্রুইনার বিদায় শুধু ম্যানচেস্টার সিটির জন্য নয়, বরং পুরো ফুটবল দুনিয়ার জন্য এক গভীর শূন্যতা তৈরি করবে। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে কষ্টকে শক্তিতে পরিণত করতে হয়, কীভাবে প্রতিকূলতার মাঝে লড়ে যেতে হয়, কীভাবে বিশ্বাসঘাতকতাকে জয় করতে হয়।

এই লেখা শুধু কেভিন ডি ব্রুইনার প্রতি সম্মান জানানো নয়, এটি একজন ফুটবল ভক্তের হৃদয়ের কথা। আমরা তাকে মিস করব, তার জাদুকরী পাস, তার অভূতপূর্ব গোল, তার মাঠে দাপিয়ে বেড়ানো চেহারা—সব কিছু আমাদের স্মৃতিতে চিরকাল গেঁথে থাকবে।

"আমি কখনোই নিজেকে সেরা মনে করিনি, কিন্তু আমি সব সময় চেষ্টা করেছি আমার সেরাটা দেওয়ার জন্য।" - কেভিন ডি ব্রুইনা

কেভিন, তুমি চলে যাচ্ছ, কিন্তু তুমি আমাদের হৃদয়ে চিরকাল থাকবে। তুমি শুধুই একজন ফুটবলার নও, তুমি আমাদের আবেগের অংশ। ধন্যবাদ, কেভিন ডি ব্রুইনা। ধন্যবাদ আমাদের ফুটবল ভালোবাসতে শেখানোর জন্য।

Post a Comment

Cookie Consent
FutbolSphere serve cookies on this site to analyze traffic, remember your preferences, and optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.