ফুটবলে অনেক রাজপুত্র এসেছেন, অনেকেই শাসন করেছেন সবুজ গালিচা। কেউ গড়েছেন কিংবদন্তির ইতিহাস, কেউবা গৌরবের মুকুটে শিরোপার পালক এঁটেছেন। কিন্তু ফ্রান্সিসকো টট্টি? তিনি শুধুই একজন খেলোয়াড় ছিলেন না, ছিলেন এক মহাকাব্যের নায়ক, যিনি সিংহাসনের মোহে নয় ভালোবাসার বাঁধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন রোমার সঙ্গে।
১৯৯৩ সালের ২৮ মার্চ ঠিক আজকের এই দিনে, এক কিশোর প্রথমবারের মতো রোমার জার্সি গায়ে মাঠে নামলেন। বয়স তখন মাত্র ১৬! স্টেডিয়ামের আলো, গ্যালারির গুঞ্জন, সবকিছুর মাঝেও তার হৃদয়ে বাজছিল একটাই সুর "আমি রোমার জন্য খেলব, আমি রোমার জন্যই বাঁচব!"
সেই শুরু। এরপর কেটেছে বছর পর বছর। ইউরোপের সবচেয়ে বড় ক্লাবগুলো দরজা খুলে রেখেছিল তার জন্য। রিয়াল মাদ্রিদ, এসি মিলান, ইংল্যান্ডের নামিদামি ক্লাবগুলো সবাই চেয়েছিল এই রাজপুত্রকে। বিশাল অঙ্কের বেতন, অগণিত ট্রফির স্বপ্ন, সেরা খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেলার সুযোগ সবই ছিল তার নাগালের মধ্যে।
তবে টট্টির কাছে ফুটবল মানে শুধু গৌরব নয়, ফুটবল মানে আত্মত্যাগ, ফুটবল মানে এক টুকরো হৃদয়কে সারা জীবনের জন্য কাউকে দিয়ে দেওয়া।
একবার রিয়াল মাদ্রিদ তাকে বলেছিল, "এসো, আমরা তোমাকে চ্যাম্পিয়ন বানাবো। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার স্বপ্ন পূরণ হবে তোমার!"
কিন্তু টট্টির উত্তর ছিল সংক্ষিপ্ত— "টাকা দিয়ে ভালোবাসা কেনা যায় না।"
২০০৬ বিশ্বকাপের পরও ক্যাসিয়াস নিজে ফোন করে তাকে দলে চেয়েছিলেন। কিন্তু টট্টি ভালো করেই জানতেন, রোমা ছেড়ে গেলে তিনি হয়তো আরও শিরোপা জিতবেন, আরও গৌরব অর্জন করবেন, কিন্তু হারাবেন তার আত্মাকে, তার অস্তিত্বকে।
কেন জানো?
কারণ রোমা তার কাছে শুধুই একটি ক্লাব ছিল না, ছিল তার হৃদয়ের এক অংশ।
২০০১ সালে, যখন রোমা সিরি আ জিতল, তখন ক্লাবের এক কর্মচারী পারিবারিক সংকটের কারণে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। টট্টি খবর পেয়েই নিজের অর্থ দিয়ে সেই কর্মচারীর পরিবারের জন্য একটি নতুন বাসার ব্যবস্থা করেন। কারণ, রোমা তার কাছে শুধুই ১১ জন খেলোয়াড়ের দল ছিল না, ছিল এক বিশাল পরিবার।
২০১৭ সালের এক বিষণ্ন বিকেল। অলিম্পিকো স্টেডিয়ামে সমর্থকদের গলায় আর কোনো চিৎকার নেই, কেবল চাপা কান্নার সুর। মাঠে দাঁড়িয়ে আছেন এক কিংবদন্তি, যার চোখের কোণায় চিকচিক করছে অশ্রুবিন্দু।
আজ শেষবারের মতো তিনি রোমার জার্সি গায়ে মাঠে নামছেন।
হাজারো হাত তাকে স্পর্শ করতে চায়, হাজারো হৃদয় তাকে ধরে রাখতে চায়। কিন্তু সময় কাউকে ধরে রাখে না।
শেষ বাঁশি বাজল। টট্টি মাঠ ছাড়লেন। গ্যালারি কাঁপছিল কান্নায়, রোম কাঁপছিল শোকে।
আজ তিনি চলে যাচ্ছেন, কিন্তু সত্যি কি তিনি চলে যেতে পারেন?
না, ফ্রান্সিসকো টট্টি কখনো বিদায় নেন না। তিনি রয়ে যান প্রতিটি রোমান হৃদয়ের এক কোণে, ভালোবাসার চিরন্তন চিহ্ন হয়ে।
রোমার প্রতি টট্টির অমর প্রতিজ্ঞা
"তুমি যখন কাঁদবে, আমি হবো তোমার কান্নার সঙ্গী, তুমি যখন লড়বে, আমি হবো তোমার ঢাল, তুমি যখন গর্বে মাথা উঁচু করবে, আমি হবো তোমার ইতিহাসের এক শাশ্বত নাম।
তোমার মাটি আমার শেকড়, তোমার আকাশ আমার স্বপ্ন, তোমার রঙ আমার রক্তের মধ্যে মিশে গেছে, তোমার নাম আমার আত্মার প্রতিচ্ছবি।
তুমি যদি ডুবে যাও, আমি তোমার সঙ্গে ডুবব, কিন্তু তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।
কারণ তুমি রোমা, আর আমি ফ্রান্সিসকো টট্টি!"
ফ্রান্সিসকো টট্টি কখনো ব্যালন ডি'অর জেতেননি, তার নাম পরিসংখ্যানের খাতায় সবচেয়ে উজ্জ্বল নয়। কিন্তু ফুটবল ভালোবাসার গল্পগুলো লেখা হয় সংখ্যার বাইরে, হৃদয়ের গভীরে।
আর সেই হৃদয়ের গভীরতম জায়গায় সবার ওপরে থাকবে একটাই নাম - ফ্রান্সিসকো টট্টি।