ফুটবল এক রঙিন স্বপ্নের খেলা, যেখানে প্রতিটি প্রতিভা একেকটি নক্ষত্র হয়ে জ্বলে ওঠে। কিছু নক্ষত্রের আলো আগেই নিভে যায়, তাদের গল্প অসম্পূর্ণ থেকে যায়, আর ফুটবলপ্রেমীরা সেই শূন্যতা নিয়ে চিরকাল বেঁচে থাকে। অস্কার এমিলিওস দস সান্তোসের গল্প তেমনই এক দুঃখের অধ্যায়, এক অসম্পূর্ণ মহাকাব্য।
অস্কারের ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে অভ্যুদয়ের মুহূর্তটি ছিল এক নতুন কাকা খোঁজার মতো। কাকা-যুগের পর, এমন একজন খেলোয়াড়ের প্রয়োজন ছিল, যিনি পুরো দুনিয়াকে দেখিয়ে দিতেন ব্রাজিলের মিডফিল্ডের নতুন প্রতিভা কী হতে পারে। তিনি ছিলেন সেই প্রতিভা, যিনি শুধুমাত্র খেলা দিয়ে নয়, তার বিশাল হৃদয় দিয়ে ফুটবল বিশ্বের অন্তর জয় করেছিলেন।
২০১২ অলিম্পিক ফাইনালে তার চোখে যে জল ছিল, তা শুধু এক খেলোয়াড়ের দুঃখের চিহ্ন নয়, বরং তার স্বপ্নেরও একটি শূন্যতা ছিল। এই শূন্যতা ছিল, যেটি ফুটবল বিশ্ব মনে রাখবে—"যতটুকু দিয়েছিলে, ততটুকু ফিরে পাওয়া যাবে না।" তবে অস্কার জানতেন, এটি কোনো শেষ নয়, বরং তার জীবনের একটি নতুন সূচনা।
চেলসিতে অস্কারের উত্থান ছিল এক নতুন যুগের সূচনা। তার প্রথম ম্যাচেই ইউভেন্তুসের বিপক্ষে যা গোল করেছিলেন, তা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে অন্যতম সেরা গোল হিসেবে চিহ্নিত। এ যেন ছিল এক শিল্পীর পেন্সিলের আঁচড়, যা ফুটবল মাঠে রেখেছিল নতুন এক ইতিহাস।
এবং তারপর, যখন কেভিন ডি ব্রুইনা চেলসির বেঞ্চে বসে থাকতেন, তখন ফুটবল বিশ্লেষকরা বুঝে গিয়েছিলেন—অস্কার শুধু একজন খেলোয়াড় নয়, তিনি ছিলেন দলের এক অমূল্য রত্ন। ব্রাজিল জাতীয় দলের জন্যও তার ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। ২০১৪ বিশ্বকাপে নেইমারের সঙ্গে তার যে বোঝাপড়া ছিল, তা ছিল যেন মেলোডির মতো।
কিন্তু ২০১৭ সালে, যখন অস্কার মাত্র ২৫ বছর বয়সে চীনের ক্লাব সাংহাই এসআইপিজিতে যোগ দিলেন, পুরো ফুটবল বিশ্ব হতবাক হয়ে গিয়েছিল। কেন এমন সময়ে ইউরোপ ছাড়লেন তিনি? অনেকেই বলেছিলেন, এটি ছিল একটি অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত, কিন্তু অস্কারের অভ্যন্তরে যে সঙ্কট চলছিল, তা ছিল আরো গভীর। তিনি হয়তো বুঝতে পারেননি, তার এই পদক্ষেপটি তার ফুটবল জীবনকে কোথায় নিয়ে যাবে।
আজ, অস্কারের ফিরে আসা যেন সময়ের সাথে খাপ খায় না। তার ফিরে আসার বার্তা এসেছে, কিন্তু তার বয়স হয়েছে, তার সেই জাদু কি ফিরবে? ব্রাজিলের যে দুঃখভরা মুহূর্তগুলো তার অভাবে কাটানো হয়েছে, তা কি পূর্ণ হবে তার ফেরার সাথে? একজন খেলোয়াড় যখন এমন একটি সময়ে ফিরে আসে, তখন প্রশ্ন ওঠে—সে কি তার পুরনো মাহাত্ম্য ফিরে পাবে?
ব্রাজিলিয়ানদের হৃদয়ে আজও একই আফসোস রয়ে গেছে—যদি অস্কার থাকতেন, তাহলে কি ব্রাজিল এত কঠিন সময় পার করত? ২০১৮ এবং ২০২২ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের মিডফিল্ডে একদম সেই অস্কারের অভাব ছিল, যে নেইমারের জন্য বল জোগান দিতে পারত। তাঁর মত একজন জাদুকরী সঙ্গী কখনোই দেখা যায়নি।
আজও নেইমার স্বপ্ন দেখে, একসাথে খেলতে পারবে অস্কারের সঙ্গে। যদি তারা আবার একসাথে ব্রাজিলের জার্সিতে মাঠে নামতে পারত! কিন্তু সেই সুযোগ আর আসে না। একে একে সময় চলে গেছে, তারা তাদের সেরা মুহূর্তগুলো পার করে ফেলেছে।
অস্কারের গল্প কখনও শেষ হবে না, কারণ তা অর্ধেক পথের গল্প, যা কখনও পূর্ণ হবে না।
একটি মহাকাব্য, যা শেষ হওয়ার আগেই ছিঁড়ে গেছে।
স্বপ্নটা শুরু হয়েছিল, রোদ ঝলমলে দিনে, সবুজ গালিচায় পা রেখে, এক জাদুকরী ছন্দে। পাসের নিখুঁত ছোঁয়া, চোখ ধাঁধানো মুভ, ফুটবল বলেছিল—"তুমি হবে ইতিহাসের এক অধ্যায় নতুন!"
কিন্তু সময় বদলাল, পথ হারিয়ে গেল, বিলাসিতার শহরে সোনার খাঁচায় বন্দী হল এক নক্ষত্র। ফিরে আসার ডাক এলো, কিন্তু সেই অগ্নিশিখা নিভে গেছে, শুধুমাত্র আফসোসের ছায়ায় এক স্বপ্ন দোলা দিয়ে যায়।
তুমি ফিরতে চেয়েছিলে, কিন্তু সময় আর অপেক্ষা করেনি!